টাংগাইলের মৃৎশিল্প

বাংলাদেশের মৃৎশিল্প সভ্যতার শুরু থেকেই এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।সভ্য জাতি হওয়ার চিন্তা থেকেই মানুষের সমাজবদ্ধ জীবন যাপন।প্রাচীন কালে মানুষ বনের পশু পাখি আগুনে পুরিয়ে খেলেও আস্তে আস্তে এটার পরিবর্তন হতে থাকে। মানুষ রান্না করা শিখে আর সেই রান্নার তাগিদ থেকেই তারা হাঁড়ি পাতিলের অভাব অনুভব করে।তখনও তাদের মধ্যে কাসা পিতল সীসা ব্যবহার করে হাড়ি পাতিল তৈরী করার মতো পরিবর্তন আসে নি। আর তখন তারা মাটি দিয়ে পাতিল তৈরী করে আগুন ব্যবহার করে রান্নার চিন্তা করে।ধীরে ধীরে সব কাজে মাটির তৈজসপত্র ব্যবহার করা হয়। এভাবেই মৃৎশিল্পে প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে নানা রকম খেলনা ও শো পিস তৈরী করে যা ঘর সাজাতে ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশ যারা মৃৎশিল্প নিয়ে কাজ করে তাদের কুমাড় বলা হয়।সনাতন ধর্মের লোকের মধ্যে পালেরা মূলত মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত। টাংগাইল জেলার বেশ কিছু উপজেলায় এখনো কিছু এলাকা জুরে মৃৎশিল্পের কাজ হয়ে থাকে।তারমধ্যে মির্জাপুর উপজেলায় প্রায় ৯৯ টি পরিবার,নাগরপুর উপজেলায় ১০৭ টি, বাসাইলে ১১৫ টি, ঘাটাইলে ৬০ টি,ভূঞাপুরে ২২০ টি, গোপালপুরে ১১২,কালিহাতিতে ২৮০ টি, ধনবাড়িতে ১০ টি এবল মধুপুরে ৯ টি, এবং টাংগাইল সদর উপজেলায় ১৫৮টি কুমাড় পরিবার বসবাস করছে।১ হাজারের বেশি পরিবার এখনো এই কাজের সাথে জড়িত। বাসাইল উপজেলায় মৃৎশিল্প নিয়ে অনেক পরিবার কাজ করে তার মধ্যে একটি পাড়া বাসাইল পৌড়সভার খুব কাছেই তার নাম কুমাড়পাড়া।

বাসাইলে আরো একটি কুমাড়পাড়া আছে রাশরা তে যেখানে এখনো সব রকম প্রতিবন্ধকতা ভুলে তৈরী হচ্ছে মৃৎশিল্পের বাহারী রকমের জিনিস। আজ ঘুরে এলাম টাংগাইল জেলার মৃৎশিল্প এলাকা থেকে। টাংগাইলে মৃৎশিল্প এলাকার মধ্যে কালিহাতি উপজেলার বল্লা ইউনিয়নের বল্লার পাল পাড়াতে ৫০ থেকে ৬০ টি পরিবার এখনো টুকিটাকি মৃৎশিল্পের কাজ করে যাচ্ছে।কিন্তু বর্তমানে কেউ ই এই পেশার আয় থেকেই জীবিকা নির্ভর করছে না, বলা চলে করতে পারছে না।তাদের বাপ দাদার কাজ ছেড়ে তাদের করতে হচ্ছে অন্য কাজ। পালপাড়ার খিতিশপালের স্ত্রী (৮০-৯০বছর)কে জিজ্ঞেস করলে জানা যায় তার জন্মের আগে থেকে এমন কি তার বাপ দাদার আগে থেকেই তার পূর্বপুরুষরা এই পেশার সাথে জড়িত।খিতিশপালের বাবা সূর্যকান্তপাল এবং দাদা যাদবপাল এই পেশার সাথেই জড়িত ছিলো।জানা যায় তাদের আরও পূর্ব পুরুষেরাও নাকি এই পেশার সাথে জড়িত ছিলো।তাই তারা এই কাজ কবে শুরু করে এবং তাদের পূর্ব পুরুষেরা কত সাল নাগাত এই বল্লাতে বসতি স্থাপন করে জানতে চাইলে তারা সঠিক কোন উত্তর দিতে পারেনি।কেবল বলেছে তাদের পূর্ব পুরুষের জন্মও এই বল্লার মাটিতেই।তাদের এই পেশা কবে থেকে শুরু হয় জানতে চাইলেও সেই একই উত্তর পাওয়া যায়। তার পূর্ব পুরুষেরা এই পেশার সাথেই জড়িত ছিলো।যা বৃটিশ আমলকেও ছাড়িয়ে যায়।২০০ ২৫০ বছরেরও আগে এই পেশার সাথে জড়িত বলতে গেলে সভ্যতার শুরু থেকে যখন এই পেশা শুরু হয় তখন তাদের পূর্ব পুরুষেরা এই কাজের সাথে জড়িত হয় এবং বংশ পরম্পরায় তারা তাদের এই কাজটিকে ধরে রেখেছে।যদিও আগের মতো আয় বা চাহিদা নেই তাদের জিনিসের।তবু পারিবারিক ভাবেই কিছু কিছু পণ্য তৈরী করছে তারা।

বাড়ির মহিলাদের আয়ের উৎস এই মৃৎশিল্প। সারাদিন বাড়িতে বসে এই কাজ গুলোই করেন তারা।তাছাড়া বাড়ির ছোট বাচ্চারাও কাজে হাত লাগায় ছোটবেলা থেকেই। ৪ বিঘা জায়গা জুরে পাল পাড়ায় প্রতিটি ঘরের মানুষ এই কাজের সাথে জড়িত। কিন্তু তাদের সমস্যা হয়েছে এক জায়গাতে,,বর্তমানে তাদের পণ্যের চাহিদা কম।স্থানীয় ভাবে কিছু চাহিদা থাকলেও বাইরে চাহিদা না থাকায় তাদের কাজের পরিমান সীমিত। গ্রামে এখনো কুয়ো করা হয় তাই এইসব কাজে তাদের একটু চাহিদা রয়েছে।বল্লাতে দই খুব জনপ্রিয় হওয়াতে আর বাইরেও দইয়ের চাহিদা থাকার কারনে প্রচুর দই তৈরী হয় প্রতিদিন।দই পাতার হাড়ির চাহিদা তাই এখনো কমে যায় নি।এই দুইটি জিনিসের চাহিদা আছে বলেই কিছু কুমাড় কোন রকম খেয়ে পরে জীবন যাপন করতে পারছে। তাছাড়া মাটির হাড়ি,কলসি,ঠিলা,সরা,সানকি, মুড়ি ভাজার হাড়ি,জান্জর ইত্যাদি তৈরী হয় সীমিত চাহিদা মিটানোর জন্য।তাছাড়া বছরের ঈদ পুজা বার্বণ, বৈশাখী মেলাতে মাটির খেলনা তৈরী করা হয় বিক্রির জন্য যদিও চাহিদা খুব বেশি নয়।ইলেকট্রনিক যন্ত্র কেড়ে নিয়েছে বাচ্চাদের জীবন থেকে এইসব মাটির খেলনা গুলো।মাটির তৈরী ব্যাংক ছিলো আগের মানুষের সঞ্চয়ের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক একাউন্ট ও মোবাইল একাউন্ট হওয়াতে ব্যাংক শুধু মাত্র শখের জিনিস এখন। অতীতে তাদের মাটির জিনিস বিক্রি করে টাকার পরিমান কম হলেও বিক্রির পরিমান বেশি ছিলো।

মুদ্রার স্ফীতির জন্য তাদের আয় বেশি দেখালেও তা জীবন ধারনের জন্য অতি সামান্য। বৃদ্ধ মহিলাটি তার কথায় সেরকম কিছুই বুঝাতে চেয়েছিলেন। বর্তমান ডিজিটালাইজেশনের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই মৃৎশিল্প। কিন্তু মাটির জিনিসের ব্যবহার আমাদের শরীর এবং মনের জন্য উপকারী। যদিও এই বিষয় নিয়ে মানুষের তেমন ধারনা নেই। বর্তমানে ই কমার্সে মাটির জিনিস অন্তর্ভুক্ত হলেও তা সব এলাকার কুমাড় সম্প্রদায়ের কাছে পৌছাইনি।এলাকা ভিত্তিক ই কমার্স উদ্যোক্তারা যদি এই সকল কুমাড় সম্প্রদায়ের লোকেদের সাথে কাজ করে তাহলে এই সম্প্রদায়ের লোকেদের নিজেদের শিল্পকে বাচিয়ে রাখা সম্ভব হবে এবং তার সাথে মানুষকেও মৃৎশিল্পের উপকারিতা সম্পর্কে জানানো সম্ভব হবে।তাতে হয়তো আবার এই শিল্পের চাহিদা বাড়বে এবং বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে। ই কমার্সের ছোয়া লাগলে মৃতপ্রায় মৃৎশিল্প হয়ে উঠতে পারে পুনরুজ্জীবিত। বর্তমানে মানুষ খুবই সৌখিন। সৌখিনতার জন্যও মানুষ মাটির তৈরী জিনিস জায়গা দিতে পারে নিজেদের ড্রয়িং রুমে।কিন্তু নদীভরাট ও নদীর নব্যতা কমে যাওয়া মৃৎশিল্পের অন্যতম প্রধান সমস্যা।চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল এখন আর পাওয়া যায় না। তাছাড়া জায়গার এভাবেও বর্তমানে এই শিল্পের তেমন প্রসার হচ্ছে না।কিন্তু এখনো এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ই কমার্স ও দেশি পণ্যের প্লাটফর্ম women and e Commerce forum(we) এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

একজন কুমোড়ের হাতের ছোয়ায় একদলা মাটি দিয়ে তারা চাহিদা অনুযায়ী যেকোন আকৃতি করে দিতে সম্ভব। তাদের এই প্রতিভাকে বাচিয়ে রাখতে ই কমার্সের গুরুত্ব অনেক।বর্তমানে ই কমার্স ই পারে মৃতপ্রায় দেশি শিল্প গুলো বাচিয়ে রাখতে।টাংগাইলের এই মৃৎশিল্প কে বাঁচিয়ে রাখতে টাংগাইলের ই কমার্স উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে এই শিল্প কে আরো দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। কালিহাতির বল্লা ছাড়াও রতনগঞ্জ,ঘোনাবাড়ি,হামিদপুরের বেতডোবা,নাগবাড়ি ইউনিয়নের কুমোড়িয়া পাড়াসহ, ধানগড়াতে বেশ কিছু গ্রামে এখনও কিছু পরিবার এই কাজের সাথে জড়িত রয়েছে।টাংগাইল জেলার বিভিন্ন উপজেলার মধ্যে কালিহাতি তে সবচেয়ে বেশি কুমাড় পরিবার রয়েছে। আর এইসব পরিবারকে যদি সরকারি ভাবে আর্থিক সহযোগিতা করা যায় এবং ই কমার্স উদ্যোক্তারা যদি এগিয়ে আসে তাহলে আমরা এই শিল্পকে আবার চাহিদা সম্পন্ন করে তুলতে পারবো।বেঁচে যাবে দেশীয় ঐতিহ্য। শারমিন জিয়া টাংগাইল জেলা সহপ্রতিনিধি ( Women and e commerce Forum (we)

https://www.facebook.com/profile.php?id=100004654728088

স্বত্বাধিকারীঃ জিয়া’স কালেকশন

https://www.facebook.com/ziascollectionbd