টাংগাইলের বিখ্যাত লৌহজাত শিল্প বিলুপ্তপ্রায় ।
DCIM\100GOPRO\GOPR0179.JPG

গৃহস্থালি ও কৃষি কাজে ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের লৌহজাত পন্যের জন্য বিখ্যাত ছিল আমাদের টাংগাইল জেলার, ঘাটাইল থানার পাকুটিয়া এলাকা। আপনারা জানেন কি? এক সময় সারা দেশে না শুধু সারা বিশ্বে হই চই ফেলে দিয়েছিল এই ঘাটাইল পাকুটিয়ার কামারেরা! পাওয়ার টিলার অর্থাৎ ট্রাক্টরের ফাল আবিষ্কার করে।বর্তমান বিশ্বে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও নানা রকম আবিস্কার হওয়ার কারনে এই শিল্পিরা আজ কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

কর্মকারঃ এক শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায় এরা এখন যদিও অনেক রকম কাজে জড়িত, আগে এরা, কেউ মাটির কাজ,কেউ লোহা,পিতল,কাসার কাজ করত। যারা মাটি দিয়ে বিভিন্ন রকম পন্য,যেমন হাড়ি,পাতিল,কলসি,ফুলের টব,মাটির ব্যাংক সহ বাচ্চাদের খেলনা,পুতুল, ঘুটি ঘটি,ঘোড়া বাঘ,ও গরুর গাড়ি এগুলো বানানোর কাজ করেন তাদের কুমার বলা হয়।

যারা স্বর্নের কাজ তথা,নানা রকম অলংকার বানানোর কাজ করেন তাদের স্বর্নকার বলে।

যারা লোহার নানা রকম নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বানানোর কাজ করেন তাদের কামার বলা হয়। আজ বলব এই কামারদের কাজ বা শিল্প নিয়ে।

অতীতে কৃষিকাজ শুরু হওয়ার সাথে সাথে এ দেশে কামার পেশার উৎপত্তি ঘটে। প্রতলিত লোক কাহিনি মতে,শূদ্র মহিলার সাথে দেবশিল্পি বিশ্বকর্মার প্রণয় থেকে কামারের জন্ম হয়। কামারদের মধ্যেও আবার কয়েকটি শ্রেনী রয়েছে,যেটা বিবাহ করার ক্ষেত্রে এখনো তারা সেই স্বশ্রেণী বেছে নেয়। বসুন্দরি,রানা,গঙ্গালিরি,এবং বাহাল। এই চার শ্রেণীর ও আবার বিভিন্ন স্তর বা শ্রেণী আছে।

যাই হোক আমরা এত গভিরে যাচ্ছিনা,কামার দের তৈরি জিনিস পত্র গুলো দেখে নেই।

দা,বটি,ছুরি,কাস্তে,শাবল খুন্তি,কুড়াল,হাতুর,লাংগল,ট্রাক্টরের ফাল,শিকল,পেরেক,চাপাতি,কোদাল,লোহার কড়াই সহ যাবতিয় নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক রকম লোহার যন্ত্রপাতি।

পাকুটিয়া এলাকা ঘুরে জানা জায় এ এলাকায় প্রায় ২৫০ টি পরিবার এই লোহার কাজের সাথে জড়িত ছিল।কিন্তু প্রযুক্তিগত যন্ত্রের কাছে তাদের হস্ত শিল্প হার মেনে যাওয়ায়, এখন মাত্র ৪০-৫০টি পরিবার এই কাজের সাথে জড়িত আছেন।বাকিরা একেক জন একেক পেশায় জড়িয়ে গেছেন। এর কারন জানতে চাইলে তারা এই মত প্রকাশ করেন যে,

আসলে এই কাজে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়,তাতেও আমাদের কোন সমস্যা নেই আমরা এই কাজ বাপ দাদার কাছে শিখেছি,করেছি,তখন এগুলোর অনেক টান ছিল,আমরা ন্যায্য মুজুরি বা পারিশ্রমিক পেতাম। বর্তমানে আমাদের বাইরেও অনেক জাতের মানুষ এই পেশায় জড়িয়ে, সস্তায় নিম্ন মানের জিনিস বানিয়ে কম দামে বিক্রি করায় আমরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সাধারণ মানুষ কোনটা ভালো মন্দ তা বিচার না করে কোনটা সস্তায় পাওয়া যায় তা কেনায় আমাদের ভালো মানের জিনিসের দাম ও অনেক কমে বিক্রি করতে বাধ্য হই।

তাছাড়া আমাদের সন্তানেরা সহ এই সমাজের চোখে এই পেশা নিম্নমানের ধরা হয়।এজন্য আমরাও কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তাদের পছন্দমত পেশায় যেতে দিচ্ছি। আমাদের অতীত ধরে বসে থাকলে তো আর চলবেনা,এখন এসবের তেমন দাম, নাম মান কোন কিছুই নেই তাই এটার প্রতি যে দরদ ভালবাসা ছিল তা দিন দিন কমেই যাচ্ছে,তারপরেও আমরা যারা একটু নিম্নবিত্তের তাদের অন্য কোন উপায় না থাকায় এই কাজ করেই জিবিকা নির্বাহ করছি।

সারদিন কাজ করে কত ইনকাম।হয় জানতে চাইলে তারা উত্তর দেন, সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৫/৬ টা পর্যন্ত কাজ করলে আমাদের ৩৫০-৫০০ টাকা ইনকাম হয়। কিন্তু সমস্যা হলো মাসের প্রতিদিন আমরা একই রকম কাজ পাইনা,দেখাযায় কোন মাসে ১০/১৫ দিন ও বসে থাকতে হয়।

পাকুটিয়ার সবচেয়ে নামকরা কামারের বংশধর অতুল কর্মকার কে এই শিল্পের ধ্বংসের কারন জানতে চাইলে তিনি একই রকম মত ব্যাক্ত করেন। তার এক ছেলে এক মেয়ে,ছেলে অন্য পেশায় আছেন,তিনি এখনো তার পেশা একাই কোন রকমে ধরে রেখেছেন।তিনি আরও বলেন,আসলে এই কাজ একা করা সম্ভব নয় মিনিমাম দুইজন লাগে এই কাজ করতে,একটা কারিগর রাখলে তার বেতন দেয়া লাগে ৫০০/৬০০ টাকা তাও কাজ করে সকাল ৮-থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।দুই জনে কাজ করলে মোটামুটি ১০০০/১৫০০ টাকার কাজ করা যায়,কিন্তু সব সময় লোক পাওয়া যায়না,আবার লোক পেলে তেমন কাজ পাওয়া যায়না।তাই আমি নিজেই টুকটাক যা পারি করি।

অতুল কর্মকারের নাতির সাথে কথা বলে তার কাছে জানতে চাই এ পেশা কি তিনি ধরে রাখবেন কিনা?

তিনি উত্তরে বলেন, আসলে আমার দাদু এই কাজ করে এটাই আমরা চাইনা,দেখতেও ভালো দেখায় না,আমার বন্ধুবান্ধবের বাপ চাচারা চাকরি বাকরি করে,আর আমরা এসব করি বললে সমাজ ও নিচু চোখে দেখে,তাই এটাতে আগ্রহ নেই।

নাতি শিক্ষিত হওয়ায় তাকে জিগ্যেস করি ই-কমার্সে আসলে এই শিল্প নিয়ে কিছু করা যায় কিনা?

তিনি বলেন,আসলে বর্তমান যুগে আবার খাঁটি পন্যের টান বাড়ায় এটা হয়ত সম্ভব,কিন্তু তার জন্য বেশ পুজি লাগবে,উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ব্যাবহার ও ৪/৫ জন লোক নিয়ে কাজ করালে ভালো একটা প্রডাকশন বের করা সম্ভব। এই পুঁজিটা আমায় কে দেবে বলেন?

অবশেষে আমরা যা বুঝতে পারলাম তা হলোঃ দেশ ডিজিটাল হয়েছে হয়ত কিন্তু আমাদের সমাজ,সমাজের মানুষের চিন্তাভাবনা ডিজিটাল না হওয়ায়, এবং কোন সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা না পাওয়ায় এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে,ভাল মন্দের তফাত গুলো আমাদের বুঝতে হবে,কোন কাজই ছোট নয়,এই বিষয় গুলো তাদের বুঝাতে হবে,বিভিন্ন ভাবে তাদের ক্ষুদ্র ঋৃনের ব্যাবস্থা করতে হবে। তাহলে হয়ত এই ঐতিহ্যবাহি পেশা বা শিল্পকে উদ্ধার করা যেতে পারে।।

হাসান সরকার ছালেহীন ourtangail.com

https://www.facebook.com/Hasansalehinbd